শত্রু/ অর্পিত সম্পত্তির মারপ্যাচে সংখ্যালঘু থেকে সংখ্যাশুন্যের পথে বাংলাদেশের হিন্দুরা

 

চন্দন সরকার

ঐতিহাসিকতো বটেই–কিছুদিন আগ পযন্ত এই অঞ্চলে বিভিন্ন ধর্মের মানুষদের সহ অবস্থান ছিল খুব শান্তিপুন্যভাবে, আমরা দেখেছি- ঈদের দিনে গোলাপ,মিন্টু, পুলকদের বাড়িতে না গেলে ওদের ঈদের আনন্দটাই যে মাটি- পাশাপাশি, ইউসুফ, শামিম স্কুলের পুজার ফল কেটে দিত, পুজার ফুল জোগাড় করতে সব সময়তো আমরা সাথে নিতাম ইউসুফকে, কারণ ফুল চুরিতে সে ছিল দক্ষ ।

ঔপনাশিক নীতি ‘বিভক্ত কর শাসন করো নীতি এই সহ অবস্থানের সংস্কৃতি বিনষ্ট হয়ে যায় আজ তা আসে পোঁচ্ছেয়েছে তলানীতে।১৯৩০ সালে দিজাতিত্তবকে প্রধান রাজনীতিক হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করা হয়।পুর্ব পাকিস্তান থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের এক বড় অংশ বিভিন্ন অত্যাচারের শিকার হয়ে দেশন্তরিত হয়েছে- প্রথমে ১৯৪৭ সনের পরপর এবং ১৯৬৫ সালের কাছাকাছি সময়ে।আর এটা করা হয়েছে অতন্ত সুকৌশলে। মজার ব্যাপার হল যুদ্ধ হয়েছিল কাশ্মীর নিয়ে ইন্ড্রিয়া–পাকিস্তানের মধ্যে আর নির্জাতিত হয়ে ভিটেমাটি হারা হন পুর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশের)হিন্দুরা।

পাকিস্তান, হিন্দুদের এই সব সম্পত্তি ফেলে যাওয়ার জন্য অতিশয় যন্তবান ছিল।হিন্দুরা যাতে এ দেশ থেকে কোন সম্পত্তি না নিয়ে অসহায় ভাবে দেশ ত্যাগ করতে পারে, তার ব্যাবস্থা করা হয়েছিল বিভিন্নভাবে। পাকিস্তানের উদ্দেশ্য ছিল যাতে করে বাঙালীদের ঐক্য, জাতীয়তাবাদী চেতনা বিনষ্ট হয়, এই অসৎ্ উদ্দেশ্যর জন্য তৈ্রী করা হয়েছিল শত্রু আইন, পরবতীতে অর্পিত আইন ।

লোক দেখানোভাবে বলা হয়েছিল-রাস্ট্র এই সম্পত্তি দেখাশুনা করবে এবং তাদের ফেরত দেওয়া হবে, কিন্তু তা না করে নিজে আর্তসাৎ করেন সুকৌশলে। ঘটনাটি ঘটানো হয়েছে উদ্দেশ্যমুলক, অমানবিক ও অগনতান্তিকভাবে–দুই ভাইয়ের মধ্যে এক ভাই যদি কোন কারনে অথবা সেচ্ছায় ইন্ড্রিয়ায় যায়, তাহলে তার পুরো সম্পত্তি হয়ে  যেতো শত্রুসম্পত্তি, আর এ ব্যবস্থার সহায়ক রাস্ট্র সয়ং।সেই সময়ের হাইকোট এবং সুপ্রিম কোর্টের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত প্রমাণ করে যে, এই আইন ব্যাপক অন্যায়, অনিয়ম ও দুর্নীতির সুযোগ করে দিয়েছিল ।আর এই আইন ব্যবহত হতো সংখ্যালঘুদের উপর।

১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্টের পর সাপ্রদায়িক দাঙার ভয়ে অনেক মানুষ  জীবন বাঁচাতে আশ্রয় নিতে চলে গিয়েছিল ভারতে–এক-দুদিনের ব্যবধানে ফিরে এসেই দেখলেন তার সম্পত্তি পরিত্যক্ত ঘোষনা করা হয়েছে, শত্রু আইনে। সরকার একটি কমিটির মাধ্যমে পারিত্যক্ত সম্পত্তির দায় দায়িতব কোনো ব্যাক্তির আবেদনের ভিত্তিতে নিতে পারতেন। আর এই ধরনের সম্পত্তি প্রয়োজন মতো ইজারা বা ভাড়া দেওয়ার ক্ষমতা কমিটিকে দেওয়া থা্কতো। বিপুল সম্পত্তি, জমি এবং দালান কোঠার মালিক হিন্দু অভিজাত শ্রেণী ও জমিদাররা  মুলত এই আইনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে নিঃসব হয়ে যায়।

১৯৫১ সালে পাকিস্তান সরকার এক আইন পাশ করেন যে সমস্ত হিন্দুরা বাড়ি ঘর ফেলে এদেশ থেকে ইন্ড্রিয়াতে চলে গেছে তাদের সম্পত্তি রক্ষনাবেক্ষন করার জন্য আইন-১৯৬৪ সালের কাস্মীর ইস্যু নিয়ে এক সাম্প্রদায়িক দাঙায় এই আইন কার্জকর হয়ে উঠে, আর এই দাঙার অজুহাতে পাকিস্তান সম্প্রদায়িক বিষবাস্পকে আরো ঘনীভুত করার এবং আরো নিঃসব করার জন্য “পুর্ব বাংলা ক্ষতিগ্রস্ত পুনবার্সন আদেশ ১৯৬৪” জারী করেন  আর অভিঘাত ছিল পষ্ট- পুর্ব পাকিস্তানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সবাই তাদের সম্পত্তির উপর মালিকানার অধিকার, বিক্রি, দান উইলসহ হস্তান্তরের অধিকার থেকে অমানবিকভাবে বঞ্চিত করা। এ উদ্দেশ্যে অশুভ বীজ আগেই বপনের কাজ পাকিস্তান বপন করে রেখেছিল।

১৯৬৫ সালের ৬ই সেপ্টেম্বর ইন্ড্রিয়া-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়, আর ১৯৬৫ সালের ৯ই সেপ্টেম্বর শত্রু সম্পত্তি আইন নিবন্ধিত করে পাকিস্তান, আর ১৯৬৫ সালের ২২ই সেপ্টেম্বর তাশখন্দ ঘোষনার মধ্য দিয়ে ইন্দো –পাক যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। আর সাথে সাথে হিন্দুদের বঞ্চনার জন্য তরী হয় এক কালো আইন- শত্রু সম্পত্তি আইন- যার মারপ্যাচের মাধ্যমে হিন্দু আজ সংখ্যালঘু থেকে নিসব হবার পথে।

১৯৬৫ সালের শত্রু সম্পত্তির মুল আইন গুলো মধ্যে ছিলঃ

১। ভারতকে শত্রু রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষনা করা হয় (যেহেতু একে অপরের সহিত যুদ্ধ)

২। ভারতের যে সমস্ত নাগরিক ভারতের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে বসবাস করে অথচ তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, সম্পত্তি, কোম্পানী, দালান কোঠা পাকিস্তানে অবস্থিত- সেগুলো নিয়ন্ত্রন নিতে হবে এবং শত্রু সম্পত্তি আইনের আওতায় নিতে হবে।(তার মানে কেউ যদি ইন্ড্রিয়ায় যেতো বা গেছে, তার সম্পত্তিই শত্রু সম্পত্তি আইনের আওতায় দখল করার মহোৎসব করা হয়)

৩।পাকিস্তান রাষ্ট্রের নিরাপত্তা যেন ব্যাহত না হয় অথবা কোনভাবে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে জন্য ব্যবসা বানিজ্য, ভু সম্পত্তি নির্মিত দালান থেকে অর্জিত মুনাফা যাতে শত্রুদের (ইন্ড্রিয়ার) হাতে না যায়।

শত্রু সম্পত্তি আইন এবং তারপর অর্পিত সম্পত্তি আইন বজায় রাখার মুলে রয়েছে এক সুগভীর এবং ঐতিহাসিক এক চক্রান্ত। যার ভিত্তি ধর্মভিত্তিক পাকিস্তান রাস্ট্রের প্রতিষ্ঠা। পাকিস্তানের সামন্ত-সামরিক শাসকদের এক উদ্দেশ্য ছিল, সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালীদের সংস্কৃতিকে সমুলে উখাৎত করা।

শত্রু সম্পত্তি/অর্পিত সম্পত্তি আইনের কাযকারিতা বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর প্রতিয়মান এবং এই কালাআইন বাংলাদেশের হিন্দুদের সবাধীনতা, মুত্তির চেতনাকে অসবীকার করে এবং অতি সুকৌশলে এবং পরিকল্পিত ভাবে সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনীতিক বঞ্চনার এক প্রতিষ্ঠানিক রুপ দেওয়ার জন্য এই আইনের সৃষ্টি।আবুল বারকাত স্যারের মতে ১৯৬৫-২০০৬ সাল পযন্ত ২৭ লক্ষ হিন্দু পরিবারের মধ্যে ১২ লক্ষের অধিক পরিবার এই কালাআইনের শিকার হয়ে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগস্ত হয়েছেন। ভূ-সম্পতির পাশাপাশি তারা হারিয়েছেন তাদের স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি।

অর্পিত সম্পত্তির জন্য আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৫৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এছাড়া মানবপুজিঁ গঠনের ক্ষেত্রে জাতীয় ক্ষতি হয়েছে অপরিমেয়। যার মধ্যে আছে, হিন্দু সংখ্যালঘুদের জোড় করে দেশত্যাগ, পারিবারিক বন্ধন ভেঙে দেওয়া, মর্মবেদনা, মানসিক অশান্তি। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নস্ট সহ ক্ষমতাহীনতা, শারিরিক ও মানুষিক দুর্বলতা, ইত্যাদিতে এই কালোআইন সহায়ক ভুমিকা হিসেবে কাজ করেছে।

৬৫-র পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের বাহানায় হিন্দুদের সম্পত্তি শত্রু সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করা হয়; বাংলাদেশের স্বাধীনতার এত বছরের মাথায় এসেও কেন এ বোঝা আমাদের বয়ে বেড়াতে হচ্ছে? হিন্দুরা পাকিস্তানের ‘শত্রু’ ছিল ভারত- পাকিস্তান যুদ্ধের সময়। তাদের সম্পত্তি শত্রু সম্পত্তি ঘোষণা করে সরকারের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যাবে- এটাই স্বাভাবিক হয়তো ছিল। কিন্তু ১৯৭১ সালে- হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে- পাকিদের হারিয়ে দেশ স্বাধীন করল; স্বাধীন বাংলাদেশে হিন্দুরা কেন শত্রু থাকবে? এ কথা কেউ ভাবে না। এ কথা দায়িত্বপ্রাপ্ত আমলা কিংবা নীতিনির্ধারক মন্ত্রী একবারও ভাবলেন না ২০০১ সাল পযন্ত।

দায়সারা ভাবে ২০০১-এ অর্পিত (শত্রু) সম্পত্তি প্রত্যাবর্তন আইন নামে আইন পাস করা হয়,এ সম্পত্তির মালিকানা কি সরকারের যে প্রত্যার্পণ করবে সরকার? তার উত্তর খুঁজতে গেলে দেখা যাবে,দায়িত্বপ্রাপ্ত বড় আমলা যাদের স্বাক্ষর ছাড়া প্রস্তাব কেবিনেটে যাবে না, তারা, হিন্দুদের এ দেশে সমান নাগরিক হিসেবে থাকারই অধিকার স্বীকার করেন না। মালিকানা সম্পত্তিতে একদিন হিন্দুদের ছিল- এ কথা তারা মানেন না ।

এই আইন বাংলাদেশের সবাধীনতা ঘোষনার মুল চেতনার পরিপন্থি, সমতা, ন্যায্যতা, সবাধীনতা, ন্যায় বিচারের পরিপন্থি। এ আইন সাম্প্রদায়িক, অমানবিক এবং অগণতান্ত্রিক। বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য এবং সত্যিকারের উপযুক্ত পরিবেশের জন্য, মানবতার জন্য, ন্যায়ের জন্য এই কালাআইন বাতিল করে আইনে ক্ষতিগস্ত প্রকৃত মালিক অথবা উত্তরাধিকারীদের কাছে সম্পত্তি ফিরিয়ে দেওয়া ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। এই যুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তান কতটা লাভ হয়েছিল আমার জানা নেই, তবে বাংলাদেশের হিন্দুরা যে নিঃসব হয়েছে সে বিষয় নিশ্চিত।

Writer: Prof of Economics and a leading human right activit and Chirman, Research and Empowerment Organization.

Prof Chandan Sarkar

Disclaimer: The facts and opinions expressed within this article are the personal opinions of the author. www.HinduAbhiyan.com does not assume any responsibility or liability for the accuracy, completeness, suitability, or validity of any information in this article. Subjected to Delhi Jurisdiction only.

Share

Compare